এডিটর্স
কলামঃ
জনবহুল এলাকায় নামীদামী
কোন রেস্তোরাঁয় ৫ বছরের মেয়ে ও ৭ বছরের ভাতিজার আবদার মেটানোর জন্য মধ্যাহ্নভোজে
গেলে চার পাশে ৪ জন। হাতে তাদের লম্বা রামদা। মাঝে ফেলে একজনকে তারা কোপাচ্ছে
ইচ্ছামতো। ভোজন রসিক কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন না। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রকাশ্য
দিবালোকে রেস্তোরাঁয়র যখন এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে, তখন চারপাশ ঘিরে আছে আরও বেশ কয়েকজন যুবক।
রেস্তোরাঁর লোকজনও দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। প্রশ্ন হতে পারে, এটি কি সিনেমার কোনো চিত্র? না, এটি কোনো সিনেমা নয়।
এ ঘটনা সোনারগাঁয়ের প্রাণকেন্দ্র মোগরাপাড়া চৌরাস্তার
এনএফসি রেস্টুরেন্টের। আর এ পুরো ঘটনাটি যাদের চোখের সামনে ঘটেছে তাদের বর্ণনায়
হাত পা কাঁপছিল। আমি যখন ঘটনাস্থলে পৌছে রক্তমাখা ফ্লোর ও সিঁড়ি দেখেছি, আঁতকে উঠেছি, এও কি সম্ভব? সারা দেশ যখন বরগুনার রিফাত
হত্যার ঘটনায় মর্মাহত, তখন সোনারগাঁয়ে আরেক রাসেল ভূঁইয়ার
উপর চলল একই স্টাইলে বর্বর হামলা। শুক্রবার সোনারগাঁয়ের এ ঘটনাটি সোনারগাঁ সহ
সারাদেশে আলোচিত হয়। ক্ষুব্ধ হয়েছেন সর্বস্তরের বাঙালিরা।
![]() |
শুক্রবার (২৮ জুন) দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদ। |
হামলাকারী
মাদক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসীদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে সারাদেশ। প্রকাশ্য দিবালোকে
নৃশংস ও বর্বর হামলার শিকার হোন সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের ছেলে ব্যবসায়ী
রাসেল ভূঁইয়া (৩২)। অন্যদিকে বরগুনায় বুধবার প্রকাশ্য দিবালোকে একদল পথচারীর সামনে
যেভাবে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা, তা স্পষ্টতই সমাজের অধঃপতনের এক
ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
এ রকম নৃশংস ও বর্বর হত্যাকাণ্ড ও হামলার নিন্দা
জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। রিফাত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
ভাইরাল হওয়ার পর সারা দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার ঝড় বয়ে গেছে। নিন্দা আর
প্রতিবাদে সরব হয়েছে সাধারণ মানুষ। রিফাত নামের ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু
পারেনি অন্য দিকে সোনারগাঁয়ের রাসেল এলোপাতারি কোপে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। কী
অপরাধ ছিল তাদের?
মানুষের অপরাধ যাই হোক না কেন, কাউকে প্রকাশ্যে এভাবে
নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা ঠিক হয়নি। কাকুতি-মিনতি করে ঘাতকদের কাছে প্রাণভিক্ষার
আবেদন জানিয়েছিল রাসেল ও রিফাত। কিন্তু ঘাতকদের মন তাতে একটুও গলেনি। স্বাধীন
দেশটাকে আজ স্বাধীন হিসেবে দাবি করাটাও লজ্জার। এ জন্য কি মুক্তিযোদ্ধারা এ
দেশটাকে স্বাধীন করেছিল? স্বাধীন করেছিল আমাদের
স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্য; কিন্তু দেখছি ঠিক তার
উল্টোটা।
![]() |
দৈনিক স্বাধীন সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। |
রাসেলকে যখন রিফাতের মত রেস্তোরাঁয় প্রকাশ্য
দিবালোকে কুপানো হচ্ছিলো তখন আশপাশে অনেকেরই উপস্থিতি ছিল, অথচ কেউই তাকে উদ্ধারের জন্য
এগিয়ে আসেনি। রেস্তোরাঁয় উপস্থিত লোকজন যদি সম্মিলিতভাবে দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ
করত, তাহলে হয়তো বা রাসেলের উপর বর্বর হামলা করতে পারতো
না। তাহলে কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক মনোবল আমরা হারিয়ে ফেলছি?
আমরা কি বর্বরতাকে রুখে দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলছি? কিছু দুর্বৃত্তের দাপটের কাছে আমরা কি জিম্মি হয়ে পড়েছি? সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা আরও অনেক নৃশংস ঘটনার উল্লেখ করা যায়।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে সমাজে কী ধরনের অরাজকতা বিরাজ
করছে। কোনোভাবেই যেন এসব নৃশংসতাকে, এসব বর্বরতাকে থামানো যাচ্ছে না। জানা যায়, রাসেলের
উপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা
হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে হামলার মূল হোতা স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী
গিট্টু হৃদয় ও তার দুইজন সহযোগীকে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করছে না
পুলিশ।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, শুধু ভিডিও থাকলে বা ছবি থাকলেই
কি প্রতিক্রিয়া বা পুলিশি একশন লক্ষ্য করা যাবে? যেসব
নৃশংস ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসছে
সেগুলোই সবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এগুলো নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু তৎপরতাও দেখা যায়।
কিন্তু অনেক ঘটনাই আছে যেগুলো তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত বা আলোচনার বাইরেই থেকে
যাচ্ছে। সব ধরনের নৃশংস অপরাধকে সমভাবে গুরুত্ব না দিলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
করা যায় না। অবস্থাপন্ন পরিবারের কেউ যদি এ ধরনের নৃশংসতার শিকার হন, তখন তাদের ঘটনাই আলোচনায় থাকে। কিন্তু দেশে অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ যে
নিয়মিতই নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন, সে খবর অনেকেই রাখেন না।
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি বলছে, আমরা যেন নৃশংস থেকে নৃশংসতর
অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে যাত্রা করেছি। জাতি হিসেবে এ ঘটনাগুলো আমাদের জন্য
উদ্বেগের। কোন পরিস্থিতিতে আমরা এমন পরিণতি বরণ করলাম তা ভাবতে হবে। আমরা জানি,
বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। ফলে প্রত্যাশা
থাকবে, এমন জঘন্য ও মর্মস্পর্শী ঘটনার দ্রুত বিচার হোক।
এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। দায়ীদের কঠোর সাজা হোক, যাতে
সমাজে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।